প্রিয় পাঠক, রমজানুল মুবারাক!সবাই কেমন আছেন?আর কদিন পরই রমজান শুরু হতে যাচ্ছে, আশা করি, সবাই সুন্দরভাবে রোজা রাখবেন, ইনশাআল্লাহ|
রমজান মাসে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে যায়|খাবারের,
ঘুমের ও ব্যায়ামের সময় অনেক পরিবর্তিত হয়| রোজা রাখলে শরীরের বিপাক ক্রিয়া
কমে যায়, শরীরের সঞ্চিত শক্তি ক্ষয় হয়ে চর্বি ভাঙ্গতে থাকে|ফলে, রোজায় একজন
পূর্ণবয়স্ক সুস্থ্য মানুসের স্বাস্থ্য ঠিক রেখে সারা মাস কিভাবে রোজা রাখা
ও পরবর্তিতে ফিটনেস ধরে রাখা যাবে, তা বিশেষ ভাবে নজর দেয়া উচিত|রোজায় কি
ভাবে খাবার খাওয়া ও অন্য কাজগুলো করা উচিত, অর্থাৎ রোজায় লাইফস্টাইল কেমন
হওয়া উচিত আমাদের সে ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া উচিত|
অনেকেই রোজায় ইফতার বা সেহরির সময়েঅতিরিক্ত খাবার খান, যার প্রয়োজন
নেই|তাই আমরা রমজান মাসে যে সব ভুল করি, তা আপনাদের সামনে উপস্থাপন
করছি|সেই সাথে এই ভুলগুলোর প্রতিকারও দিচ্ছি|
ভুল গুলো ও তার প্রতিকার:
১. ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া:অনেকে মনে করেন ইফতারে ভাজা
পোড়া না থাকলে ইফতারই হবে না| কিন্তু একটু চিন্তা করেন তো ভাজা পোড়া
একবারে এতো বেশি খেলে কি হবে? সারাদিন রোজা রেখে আমাদের পাকস্হলি খুব
ক্ষুধার্ত ও দুর্বল থাকে| তারপর যদি এত রকম গুরুপাক খাবার একসাথে খাওয়া
হয় তাহলে কি অবস্থা হবে? অনেক সময় ধরে না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের এনজাইম,
যা হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরী হয়,তা বন্ধ থাকে| তাছাড়া পাকস্থলীর ভিতরের
মিউকাস আবরণও সংকুচিত অবস্থায় থাকে, ফলে যদি কোনো ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত,
গরম, গুরুপাক খাবার হঠাত করে পেটে পড়ে, তবে পেটে জ্বালা পোড়া করতে পারে|
পেটের সমস্যা,মাথাব্যাথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, দুর্বলতা, অবসাদ, ulcers, acidity,
হজমের সমস্যা, ইত্যাদি হবে রোযার নিত্য সঙ্গী| তাছাড়া এই খাবারগুলোর
ক্যালোরিমান অনেক|ফলে ওজন বাড়তে বাধ্য|
জেনে নিন ইফতারের খাবার গুলোর ক্যালরির মান|
সঠিক নিয়ম: ভাজাপোড়া খাবার বাদ দিয়ে সহজপাচ্য খাবার,
যেমন: চিড়া-দই, লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, নুডুলস, নরম খিচুড়ি ইত্যাদি
খেতে পারেন, সাথে সবজি, ফল, সালাদ, মাছ বা মাংশ বা ডাল বা ডিম থাকবে|
২.চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় খাওয়া: চিনি যুক্ত খাদ্য ও পানীয় আমাদের শরীরে দরকার নেই
,
চিনি যুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে| কারণ এটা খুব তাড়াতাড়ি রক্তে
চিনির(ইনসুলিন) মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে সাময়িকভাবে ব্রেইনে শক্তি
জোগালেও একটু পরেই তা স্তিমিত হয়ে যায় এবং শক্তিহীন মনে হয়|তাছাড়া চিনি
একটি পরিশোধিত শর্করা, যা শরীরের বিভিন সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমন:ওজন
বাড়ায়| অনেক খাবার, যেমন: মিষ্টি, ফালুদা জিলাপি,কেক,
বিস্কিট,কর্নফ্লেক্স ইত্যাদি রোজায় খাওয়া হয়, কিন্তু এগুলো প্রচন্ড
চিনিযুক্ত ও ক্যালোরীবহুল|এগুলো রোজায় প্রতিদিন খাবেন না|
রোজায় অনেকে চিনিযুক্ত কোমল পানীয় পান করেন, যা ঘুমের সমস্যা,acidity, ulsers, ওজন বাড়া, ইত্যাদির কারণ |
সঠিক নিয়ম: চিনি মুক্ত খাবার ও পানীয় খান, যেমন: ফলের
শরবত, ফল ইত্যাদি|কোমল পানীয় না পান করে,ইফতার থেকে সেহেরী পর্যন্ত প্রচুর
পানি পান করুন|ডাবের পানি পান করতে পারেন|©
fitnessbd.net
৩.জটিল শর্করা না খাওয়া: শর্করা আমাদের শরীরে শক্তি
যোগায়, তাই অনেকে রোজায় বেশি বেশি শর্করা খান, যেমন: ভাত বেশি করে খান|
আমাদের দেশে সাধারনত: সাদা ভাত বা সাদা আটা খাওয়া হয়| যা শরীরে ইনসুলিন এর
মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে একটু পরেই খেতে ইচ্ছা করে, তাছাড়া এগুলো হজম হতে
সময় কম লাগে, ফলে ক্ষুধা তাড়াতাড়ি লাগে|
সঠিক নিয়ম: সাদা শর্করা বাদ দিয়ে লাল শর্করা: যেমন
:
লাল আটা, লাল চাল, এগুলো খান| এগুলোতে low-glycaemic index থাকে,তাইহজম
হয় আস্তে আস্তে, এবং অনেক সময় পরে ক্ষুধা লাগে| রক্তে চিনির পরিমান
তাড়াতাড়ি বাড়ে না|
৪. গুরুপাক খাবার খাওয়া: অনেকে ভাবেন ভাজাপোড়া খাবার
খাবেন না, কিন্তু পরিবর্তে অন্য গুরুপাক খাবার, যেমন: বিরিয়ানি, তেহারি,
হালিম, ছোলা ভুনা, জাঙ্কফুড ইত্যাদি খান|
সঠিক নিয়ম:ফাইবার সম্দৃধ্য ও সহজপাচ্য খাবার, যেমন:
লাল আটা, বাদাম, বিনস, শস্য, ছোলা, দুধ, মিষ্টি আলু, ডাল, ফল, সবজি, সালাদ
ইত্যাদি খেতে হবে কম তেলে রান্না করে|প্রতিবেলা মাংস না খেয়ে অন্তত এক
বেলা মাছ খেতে চেষ্টা করুন|খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর ও সব গ্রুপের খাবার
থাকতে হবে, যেমন: আমিষ, শর্করা, ফ্যাট, ভিটামিন, দুধ, দই, মিনারেলস, ফাইবার
ইত্যাদি খেতে হবে নিয়ম মত|সুষম খাবার(balance diet)খেতে হবে| অতিরিক্ত
ঝাল মশলা যুক্ত, ভুনা ও লবনাক্ত খাবার বাদ দিন|হজম হতে সময় নেয় যে সব
খাবার: যেমন:লাল আটা, লাল চাল, ডাল,বিনস,বাদাম, দুধ, চর্বিবিহীন মাংশ
ইত্যাদি এগুলো খান|
৫.একবারে অনেক খাবার খাওয়া বা ক্যালোরি মেপে খাবার না খাওয়া :
সারাদিন রোজা রেখে সবাই আমরা ইফতারের সময়ের অপেক্ষায় থাকি| ভাবি ইফতারের
সময়ে পাগলের মতো খাবো|এই পাগলের মতো বা বেশি মাত্রায় খাওয়ার ফলে, রোজার যে
আসল উদ্দেশ্য–সংযম, সেই সংযম কিন্তু এতে নষ্ট হয়ে যায়|সেই সাথে নষ্ট হয়
আমাদের শরীরের হজম প্রক্রিয়া|তাছাড়া একসাথে এতরকমের ও এত বেশি খাবার খাওয়ার
ফলে, ওজনও বেড়ে যায়|পেটের সমস্যা,গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদিও হতে পারে
আবার অনেকে সেহেরিতেও অনেক বেশি খান,মনে করেন, বেশি খেলে পরে ক্ষুধা লাগবে না, এটি ভুল ধারণা|একবারে বেশি খেলে ওজন বাড়বেই|©
fitnessbd.net
সঠিক নিয়ম: অন্য সময়ের মতই রমজানে বারে বারে অল্প করে
পরিমিত পরিমানে খান|যেমন: ইফতার অল্প করুন, একটু পরে অল্প রাতের খাবার
খান,সেহেরীতেও পরিমিত খান| ইফতার, রাতের খাবার ও সেহেরী এই তিন বেলাই খাবার
খাবেন| কোনো বেলা খাবার খাওয়া বাদ দিবেন না| তাহলে দুর্বল হয়ে যেতে
পারেন| রোজার মাসেও স্বাভাবিক সময়ের মতো ক্যালরি মেপে, পরিমিত পরিমানে
খেতে হবে|যার যার শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে ক্যালোরির
চাহিদা অনুযায়ী খাবার খেতে হবে|
রমজানে রোজা ভাঙ্গার স্বাস্থ্যসম্মত উপায় জানুন|
খাদ্যের ক্যালরি এবং আমাদের শরীরে প্রভাব সম্পর্কে জানুন|
৬. সেহেরী না খাওয়া: সেহেরিতে একেবারেই না খাওয়া ঠিক
নয়, প্রথমত, সেহেরী খাওয়া সুন্নত| সেহেরী না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যেতে
পারে| অনেকে মনে করেন, একবেলা, ইফতারে খেলে ওজন কমবে| কিন্তু এতে হিতে
বিপরীত হবে, শরীর দুর্বলতো হবেই, ওজন কমবে না, বরং বাড়বে|তাছাড়া সেহেরী না
খেলে বিপকক্রিয়া পরিবর্তন হয়ে শরীরের সঞ্চিত শক্তি ক্ষয় হয়, ফলে দেহে
ক্লান্তি আসে ও রোজা রাখতে অনেক কষ্ট হয়|
সঠিক নিয়ম: কষ্ট হলেও সেহেরি খান| একটু পানি, ফল বা দুধ হলেও খান|
নমুনা ইফতার এবং সেহেরি কেমন হবে, তা জানতে ক্লিক করুন|
৭. ক্যাফেইন যুক্ত পানীয় বা খাদ্য খাওয়া:রোজায় চা,
কফির মাত্রা কম হতে হবে| তা না হলে পানিশুন্যতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুমের
সমস্যা হতে পারে |কারণ, ক্যাফেইন হলো diuretic, যা শরীর থেকে পানি বের করে
দেয়|
সঠিক নিয়ম: চা বা ক্যাফেইন খেতেই হলে, হালকা
ক্যাফেইনযুক্ত খান, যেমন:গ্রিন টি| সেহেরিতে ক্যাফেইন খাবেন না, সারাদিন
তাহলে পানি পিপাসা লাগবে| শরীরে পানিশুন্যতা হবে|©
fitnessbd.net
৮.রোজা রেখে ব্যায়াম করা : অনেকে রোজা রেখে ব্যায়াম
করেন, এটি খুবই খারাপ অভ্যাস| কারণ ব্যায়ামের আগে, পরে আমাদের শরীরে
পুষ্টিকর খাবার দরকার| রোজা রেখে ব্যায়াম করলে শরীর তা পাবে না| তাছাড়া
ব্যায়ামের সময় শরীরে যে পানি দরকার, তাও পাবে না| ফলে হিতে বিপরীত হবে–শরীর
দুর্বল হয়ে যাবে, মেটাবলিজম কমে যাবে ও মাসেল নষ্ট হয়ে, শেপ নষ্ট হয়ে যাবে
|©
fitnessbd.net
সঠিক নিয়ম: ইফতারের কিছু সময় পরে অল্প সময় ধরে, হালকা
ব্যায়াম করুন| অতিরিক্ত সময় ধরে বা খুব ভারী ব্যায়াম করবেন না| কারণ একে তো
সারাদিন না খেয়ে শরীর দুর্বল, আবার বেশি ভারী ব্যায়াম করলে রাতে ঘুম আসবে
না|
রোজার ব্যায়াম কেমন হবে, তা জানতে ক্লিক করুন|
৯.রমজানে অনেক পরিশ্রম করা ও দৈনন্দিন রুটিন অন্য সময়ের মতো রাখা : অনেকে
মনে করেন রোজা রেখেও সারাদিন অনেক কাজ করবেন| রমজানে অফিস টাইম কিন্তু
কমিয়ে দেয়া হয় এ জন্যে যে, দুপুরের পরে ব্রেইন এর কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে|
সঠিক নিয়ম: কষ্টকর কাজগুলো সকালে করে ফেলুন, যখন ব্রেইন ঠান্ডা থাকে|দুপুরের পরে শরীর ও ব্রেইন নিস্তেজ হয়ে পড়ার আগেই|©
fitnessbd.net
১০.রোজা রাখাকে ওজন কমানোর উপায় মনে করা: অনেকে মনে
করেন রোজা রেখে ডায়েট করবেন ও ওজন কমাবেন| এটি ভুল, কারণ রোজা রেখে আপনি
আল্লাহর ইবাদত করছেন, আল্লাহ রোজার মাস দিয়েছেন বেশি বেশি ইবাদাত বন্দেগী
করতে, আত্মশুদ্ধি করতে|রোজা রাখলে এমনিতেই শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যায় ও
রোজার অনেক শারীরিক উপকারিতাও আছে|তাছাড়া রোজা রাখলে কিছু ক্যালোরি খরচও
হয়|তাই রোজার মাসকে ডায়েটিং এর মাস না মনে করে আল্লাহতালা আখিরাতকে লাভ
করার যে অপূর্ব সুযোগ দিয়েছেন, তা আমাদের গ্রহণ করা উচিত|
সঠিক নিয়ম: ডায়েটিং এর দিকে নজর না দিয়ে
পরিমিত,পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য খাবার খেয়ে ইবাদাত বন্দেগিতে মনোযোগ দিন| রোজায়
আপনার ওজন কমানো বা বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে ফিটনেস ধরে রেখে সারা মাস
রোজা রাখা ও রোজার পরে শরীর সুস্থ্য রাখার দিকে নজর দিন |
মনে রাখবেন, রোজায় সুস্থ্য থাকতে পরিমিত খাওয়া, স্বাস্থ্যসম্মত ও
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, কর্মচঞ্চল থাকা, আর নিয়মিত সঠিক ব্যায়াম চালিয়ে
যাওয়া দরকার| রোজার মাস হতে পারে আমাদের সংযমী হয়ে খাওয়া ও ইবাদত বন্দেগির
মাস|
অনেকে হয়তো ভাববেন বাসার সবাই যেমন, তেমন ভাবে চলতেই হবে, যেমন:ভাজাপোড়া
খাবার খাওয়া, কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই আমরা অভ্যাস বদলাতে পারি এবং
পরিবারের সবাইকে সঠিকভাবে চলার উত্সাহ দিয়ে সবার উপকার করতে পারি| আবার
আমরা রোজায় যেনো খাবারের আয়োজনে উন্মত্ত হয়ে যাই|কিন্তু এটি খুব ভুল
অভ্যাস|খাবার নিয়ে অর্থ ও সময়ের অপচয় না করে ইবাদত বন্দেগিতে মন দেয়া উচিত ও
রমজানের সংযম শিক্ষা করে, নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত|তবেই আমরা আল্লাহর
প্রিয় বান্দা হতে পারবো এবং নিজের যত্ন নিয়ে, নিজের ও পরিবারের সবার দিকে
লক্ষ্য রাখতে পারবো|মনে রাখবেন–অভ্যাস মানুষের দাশ, মানুষ অভ্যাসের দাশ
না|তাছাড়া রোজায় অতিরিক্ত খাবার খাওয়া কিন্তু ইসলামের শিক্ষা না|
সবাইকে আল্লাহতালা সুন্দর ও সঠিকভাবে রোজা পালন করার তৌফিক দান করুন, আমীন|